অবৈধ ক্যাসিনো আর জুয়ার অন্ধকার জগৎ তাদের কাছে ধরা দেয় অনেকটা আলাদিনের চেরাগ হয়ে।
দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর বাইরে তারা শাসকদলের নেতা হওয়ায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এনু গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং তার ভাই রূপন একই কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক। শুধু এ দুজনই নন, এরা এতটাই প্রভাবশালী যে, পরিবারের ১৭ সদস্য রয়েছেন গেন্ডারিয়া থানা ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটিতে।
গতকাল এই দুই ভাই গ্রেফতারের পর তাদের সম্পদের হিসাব-নিকাশ নিয়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি নগদ টাকা নয়, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এনু-রূপনের বাড়ি আর প্লটের সংখ্যা মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় কর্মকর্তাদের। প্রাথমিক অনুসন্ধানেই যা পাওয়া গেছে, তাতে হতবাক সিআইডির ঝানু সব কর্মকর্তারা। এখন পর্যন্ত এনু-রূপনের মালিকানাধীন ২২টি বহুতল বাড়ি, প্লট আর বাগানবাড়ির সন্ধান মিলেছে। ৯১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে এই দুই ভাইয়ের নামে। এসব ব্যাংক হিসাবে তারা লেনদেন করেছেন হাজার কোটি টাকা। বিগত তিন মাসে বিদেশে পাচার করেছেন ১০০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের শেয়ারহোল্ডার এই দুই ভাই প্রতি রাতে মতিঝিলসহ বিভিন্ন ক্লাবের ক্যাসিনো ও জুয়ার ব্যবসায় পাওয়া টাকা বাসায় এনে রাখতেন।
সূত্রাপুরের বানিয়ানগরের নিজ বাড়িতে টাকা রাখার জায়গা শেষ হয়ে যাওয়ায় ভল্ট বানিয়ে নেন। তবে সেখানেও টাকা রাখার জায়গা হতো না। নিজেদের বাসা বাড়ির জায়গা ফুরিয়ে যাওয়ার পর বন্ধু-বান্ধব এবং কর্মচারীদের বাসার দিকে নজর দেন তারা। সেখানে রীতিমতো ব্যাংকের মতো বড় ভল্ট বানিয়ে দেন। সেখানে রাখতে থাকেন টাকার বান্ডিল।
একটা সময় সেখানেও টাকা রাখার জায়গা শেষ হয়ে যায়। এরপর টাকা দিয়ে সোনা কিনে ভল্ট ভর্তি করতেন। আর এসব সম্পদ রক্ষা করত তাদের অবৈধ অস্ত্রধারী বাহিনী।
ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের শুরুর দিকে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর এনু-রূপন এবং তাদের দুই সহযোগীর বাসা থেকে ৫ কোটির বেশি টাকা, ৮ কেজি সোনা ও ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর ও ওয়ারী থানায় সাতটি মামলা হলেও এনু-রূপন এবং তাদের দুই সহযোগী হারুন অর রশিদ ও আবুল কালাম গা-ঢাকা দেন। মামলাগুলোর মধ্যে মানি লন্ডারিং আইনের চারটি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। দীর্ঘদিন ধরে তাদের খুঁজছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু কোথাও খোঁজ মিলছিল না। গেন্ডারিয়ার ত্রাস এনু-রূপনের অগাধ সম্পদ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর অ্যাকাউন্ট থেকে তড়িঘড়ি করে সরানো হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু সাড়ে ২২ কোটি টাকা শেষ পর্যন্ত সরানো যায়নি। তলানিতে পড়ে থাকা এই অর্থ এখন আছে বাজেয়াপ্তের অপেক্ষায়। তবে শুধু এই একটি অ্যাকাউন্ট নয়, এ রকম আরও ৯১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে দুই আওয়ামী লীগ নেতার নামে। এসব ব্যাংক হিসাবে তারা লেনদেন করেছেন কয়েকশ কোটি টাকা।
শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি নগদ টাকা নয়, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এনু-রূপনের বাড়ি আর প্লটের সংখ্যা মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে সিআইডি। কারণ প্রাথমিক অনুসন্ধানেই যা পাওয়া গেছে, তাতে হতবাক না হয়ে উপায় নেই। এখন পর্যন্ত এনু-রূপনের মালিকানাধীন ২২টি বহুতল বাড়ি ও একাধিক প্লটের সন্ধান মিলেছে।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, দুই ভাইয়ের দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই। কয়েকটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে তারা অর্থ লুকানোর চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন।
এনু এবং রূপন ভূঁইয়ার ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত দলিলপত্র ঘেঁটে জানা যায়, পুরান ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় এনু ও রূপনের নামে একের পর এক হিসাব খোলা হয়। সবচেয়ে বেশি হিসাব খোলা হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও স্ট্যান্ডান্ড চার্টার্ড ব্যাংকে। বড় অঙ্কের টাকা জমা রাখার কারণে ব্যাংকগুলো এনু-রূপনকে বরাবরই বিশেষ ব্যাংকিং সুবিধা দিত। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে তারা ভিআইপি গ্রাহক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, এনু ও রূপন গত ৬-৭ বছরে পুরান ঢাকায় বাড়ি কিনেছেন কমপক্ষে ১২টি। ফ্ল্যাট কিনেছেন ৬টি। পুরনো বাড়িসহ কেনা জমিতে গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন ভবন। এই দুই ভাইয়ের মূল পেশা জুয়া। আর নেশা ছিল বাড়ি কেনা। এগুলো হলো ৪০ গুরুদাস সরদার লেনে ২০ তলা নির্মাণাধীন বাড়ি, ১ নম্বর নারিন্দা লেনে ৪ তলা বাড়ি, ৬/২ গুরুদাস সরদার লেনে একটি নির্মাণাধীন বাড়ি, ৩৯ নম্বর শরৎগুপ্ত রোড (দাদা ভাই বাড়ি) ১৬ কাঠা জায়গা, ৬৯ শাহ সাহেব লেনে ১০ তলা বাড়ি, ৭৩ নম্বর শাহ সাহেব লেনে আরেকটি বাড়ি, ১২৪/৫ ডিস্টিলারি রোড মুরগিটোলায় ৭ তলা বাড়ি, ৩৯ ডিস্টিলারি রোডে আরেকটি পুরনো বিল্ডিং। ওয়ারী এলাকার লালমোহন শাহ স্ট্রিটে ৪টি বাড়ি আছে। এগুলো হলো ১০৬ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১০ তলা বাড়ি (মমতাজ ভিলা), ১২২/এ ১২১ এবং ১০৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে আরও দুটি বাড়ি, ৪৪/বি ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ৪ তলা বাড়ি, ৭১/১ দক্ষিণ মৈসুন্দি এলাকায় আরেকটি বাড়ি, ধোলাইখাল হানিফ গার্মেন্টের সঙ্গে বাঁধন এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মুরগিটোলা মোড়ে এনু-রূপন স্টিল হাউস, কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া এবং মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে দুটি বিশাল বাংলোবাড়ি।
জুয়ার টাকায় ক্ষমতাসীন দলের পদও কেনেন। ২০১৮ সালে এনু পান গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ। আর রূপন পান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। তাদের পরিবারের ৫ সদস্য, ঘনিষ্ঠজনসহ মোট ১৭ জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে পদ পান।
গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে ওয়ান্ডারার্সে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সরঞ্জাম, কয়েক লাখ টাকা ও মদ জব্দ করে র্যাব। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর বানিয়ানগরে এনামুলের ছয়তলা বাড়ির দোতলা ও পাঁচতলায় তিনটি বড় ভল্ট পাওয়া যায়। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ভল্টগুলো খুলে এর মধ্যে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা ও ৭২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া যায়। ৮ কেজি ওজনের এই স্বর্ণালঙ্কারের মূল্য চার কোটি টাকার বেশি। এরপরই ওই বাড়ি থেকে তথ্য নিয়ে লালমোহন সাহা স্ট্রিট ও নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডে এনামুলের কর্মচারী ও বন্ধুর বাসায় অভিযান চালিয়ে আরও দুই কোটি টাকা এবং তার এক কর্মচারীর বাসায় রাখা ভল্ট থেকে দুই কোটি টাকা জব্দ করা হয়। অভিযানে তিনটি রিভলবার, রাইফেলসহ বিভিন্ন ধরনের ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। দুই ভাই এসব অস্ত্র ব্যবহার করে অনেককে জিম্মি করতেন বলে র্যাব জানতে পেরেছে।
ওয়ার্কশপের পাশাপাশি এনামুলরা ৯০ দশক থেকেই জুয়া ও হাউজি খেলার সঙ্গে যুক্ত। তখন এত টাকা-পয়সা ছিল না। গত দুই-তিন বছরে এরা ফুলেফেঁপে কলাগাছে পরিণত হয়। দলীয় পদ থাকায় তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
শুভাঢ্যার শ্যামল ছায়া কমপ্লেক্স নামে ১০ তলা ভবনের ৫ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সিআইডি জানায়, ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন দুই ভাই। রাতে ঘুমুতেন টয়লেটের ফলস রুমে। দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে স্বেচ্ছাবন্দী থাকা অবস্থায় একবারের জন্যও তারা বের হননি।
গতকাল দুপুর ২টায় সিআইডির কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির ডিআইজি (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, ক্যাসিনোর টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়া রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু, তার ভাই একই কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়ার কাছে ৪৬ লাখ টাকা ছিল। এই টাকা দিয়ে তারা ভুয়া পাসপোর্ট করে ভারত হয়ে নেপাল, এরপর দুবাই যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন।